সপ্তকের ইতিহাস, সপ্তকের স্মৃতিকথা

সপ্তকের ইতিহাস, সপ্তকের স্মৃতিকথা

সপ্তকের ইতিহাস, সপ্তকের স্মৃতিকথা

মাগুরা সাহিত্যের বাক বদলে সপ্তক এর ভূমিকা

শিকদার ওয়ালিউজ্জামান

১৯৯৮ সালে খন্দকার রাশিদ আশরাফ, শিকদার ওয়ালিউজ্জামান, হাফেজা আনােয়ার, রাশেদুল ইসলাম সাজ্জাদ, খন্দকার ইদ্রিস আলী, আশীষ রায়, এস এম তুষার আলমসহ আরাে অনেক তরুণ সাহিত্যপ্রেমীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে অনির্বাণ সাহিত্য সংসদ’। শিকদার ওয়ালিউজ্জামান এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাহিত্যের কাগজ ‘নদীপ্রবাহ’। নবীন লেখিয়েদেরকে নিয়ে কবিতার আড্ডা শুরু হয়। ২০০৬ সালে ‘মাগুরা সাহিত্যিক কল্যাণ পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মাগুরাস্থ সৈয়দ আতর আলী পাঠাগারে শুরু হয় সাহিত্য আসর। বিবেকানন্দ মজুমদার, এম এ হাকিম, পরেশ কান্তি সাহা, অমৃত বিশ্বাস, মােঃ আব্দুল কুদ্দুস, দাউদ হােসেন, হাসানুজ্জামান হাসান, সাহান আরা মিশি, খান জান্নাতুল ফেরদৌস আলাপী, হাসান সাব্বির, শেখ কাজল আজাদ, আঃ রশিদ মিয়াসহ আরাে অনেকেই এই আসরে আসতেন। তখন ‘ঘাসফুল’ প্রকাশিত হয়। ২০০৭ সালে অনির্বাণ সাহিত্য সংসদ পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে প্রতি মাসের প্রথম ও তৃতীয় শুক্রবার সাহিত্য আসরের আয়ােজন করে। এ সব আসরে বিকাশ মজুমদার, হাফেজা আনােয়ার, শিকদার ওয়ালিউজ্জামান, ফসিয়ার রহমান, পরেশ কান্তি সাহা, ডা. নাসিরুল ইসলাম, এম মনির-উজ-জামান, বীরেন মুখার্জী, সাগর জামান, কাব্য মােস্তফা, জিল্লুর রহমান খান, এস এম কামরুজ্জামান, সঞ্জিত বসু, কাজী সিরাজ মিহির ও হাসান সাব্বিরসহ আরাে অনেকে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা নিয়ে আলােচনা করতেন। ২০০৮ এ সঞ্জিত বসুর সম্পাদনায় ‘মাটি’ এবং জিল্লুর রহমান খান এর সম্পাদনায় ‘আঁচড়’ প্রকাশিত হয়। ২০১১ সাল মাগুরার সাহিত্যে বৈপ্লবিক সময়। অনির্বাণ সাহিত্য সংসদ ভেঙে গেলে শিকদার ওয়ালিউজ্জামান ও হাসান সাব্বিরের যৌথ আলোচনা থেকে একটি সমৃদ্ধ লিটল ম্যাগ প্রকাশের স্বপ্ন জেগে ওঠে। ব্যস। নাম ঠিক হলো ম্যাগটির নাম হবে সপ্তক। নামের সার্থকতা রাখতে সাত মৈত্রির সিদ্ধান্ত হলো। সাত কবি। বিকাশ মজুমদার, অনিল দে মণি, কাব্য মোস্তফা, আফরোজ জাহান, এম মনির উজ জামান, শিকদার ওয়ালিউজ্জামান ও হাসান সাব্বির। মিটিং হলো। ফেব্রুয়ারিতেই প্রকাশ হবে সপ্তক। লেখা সংগ্রহ শুরু হলো। এ সংগ্রহে বীরেন মুখার্জী ও অরবিন্দ চক্রবর্তীর অবদানকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। অরবিন্দ বিভিন্ন জেলার লেখকদের নম্বর দিয়ে সহযোগিতা করেছে দারুণভাবে। যোগাযোগ করলাম ‘সময়’‘কবি’ কাগজের সম্পাদক সজল আহমেদের সাথে। বয়সে তরুণ হলেও ছোট কাগজ প্রকাশে তার অনেক আগে থেকেই বিস্তর অভিজ্ঞতা। তার আন্তরিকতা ও দক্ষতার সান্যিধ্য না পেলে আমাদের আজকের অবস্থানে আসতে আরো অনেক সময় লাগতো। সজল আমাদেরকে শব্দকলি প্রিন্টার্স এর কাজল কাকার কাছে নিয়ে গেল। ছোট কাগজের প্রতি কাজল কাকার অনুরাগ সম্পাদকদেরকে মুগ্ধ করবেই। তার আগে অগ্রজ কবি এম আসলাম লিটন এর উদারতার সন্ধান দেয় দ্বিতীয় দশকের কবি সানাউল্লাহ সাগর। লিটন ভাই প্রচ্ছদ করে দিলেন। তার লোগোটিকেই আমরা স্থায়ি করে নিয়েছি। সপ্তকের প্রথম সংখ্যাটিতে কবি বীরেন মুখার্জীকে নিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। সপ্তক প্রকাশ করতে আমাকে ব্যাংক থেকে দশ হাজার টাকা ঋণ নিতে হয়। বাকি দশ হাজার টাকা স্থানীয় বিজ্ঞাপন থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। প্রত্যেক লিটলম্যাগ সম্পাদকের এমন স্মৃতি আছে বলে আমি মনে করি। ২০১১ সালের মাঝামাঝিতেই আমাদের সাথে যুক্ত হয় কবি নিষাদ নয়ন আর তুষার প্রসূন। আমরা হলাম সাত থেকে নয়। সপ্তক প্রকাশের বছরই গঠন হলো সপ্তক সাহিত্য চক্র। নতুন আঙ্গিকে মাগুরায় কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, নাট্যকার ও সাহিত্যমোদিদের নিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সপ্তক এর আড্ডাসমূহ সেন্টুর চায়ের দোকান, সৈয়দ আতর পাবলিক লাইব্রেরী, নােমানী ময়দান, এ জি একাডেমী স্কুল প্রাঙ্গণ, সাতদাহা আশ্রম, মাগুরা কফি হাউজ, সরকারী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী কলেজ প্রাঙ্গণসহ বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত হতে থাকে। সপ্তক এর সাহিত্য সমাবেশ আয়োজনে কবি অসীম সাহা, তপন বাগচী, ওয়ালী কিরণ, আশরাফ রোকন, শামীম হোসেন, তপন বর্মন, সমর চক্রবর্তীসহ আরাে অনেক খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক অংশগ্রহন করেছেন। ২০১১ সালে সপ্তক’র সেই পাঠচক্র অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনকারী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সতীর্থ’ গ্রুপের অনেক তরুণ বর্তমানে কবিতায় বেশ যশস্বী হয়ে উঠেছে। সপ্তক এর মাধ্যমেই ঝিনাইদহের কবি সুমন শিকদার, অতীন অভিক, কাজী গিয়াস আহমেদ, তপন রায় প্রমুখের সাথে মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে।  সপ্তক প্রকাশের বছর দু’য়েক আগে থেকেই পেশায় ডাক্তার, কবিতায় অনন্য নাসিরুল ইসলাম (নাসির জুয়েল) সপ্তক পরিবারের সাথেই একাত্ম হয়ে আছেন। প্রবাসি কবি নাসিরুল ইসলাম মাগুরায় এলেই সপ্তক পরিবারের আড্ডা যেন প্রাণ পায়। শুরুর পথে সপ্তক কিন্তু নারায়নগঞ্জের কবিবন্ধু নাজমুল বাবুর প্রতি ঋণী হয়ে আছে। সপ্তক এর ফেসবুক গ্রুপটি তার হাতেই খোলা।

২০১১ সালে সপ্তক এর পরিবার ছিল ছোট কিন্তু দম ছিল দুর্দান্ত। সিদ্ধান্ত হলো সপ্তক এর দ্বিতীয় প্রকাশের। পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এলেন সমাজসেবক এডভোকেট সৈয়দ শরিফুল ইসলাম, মনোয়ার হোসেন খান, খান ইমাম হোসেন পিকুল ও কানিজ আক্তার কলি। প্রচ্ছদ করে দিয়ে আমাদেরকে ঋণী করলেন শতাব্দী জাহিদ। সজল আহমেদ যথারীতি এবারও সহযোগিতার হাত বাড়ালো। শব্দকলির নূরুল হক ইমন এর দক্ষ পরিচর্যায় আগস্টেই প্রকাশিত হলো সপ্তকের দ্বিতীয় সংখ্যা। পত্রিকাটি উৎসর্গ করা হয়েছিল ঐ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বরেণ্য ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ আর মিসুক মুনীরকে। মাগুরা থেকে গৃহীত বিজ্ঞাপনগুলো গোছানোর কাজ করেছি মাগুরার অহনা প্রিন্টার্স এর জামালের কাছ থেকে। তার প্রতিও আমরা সপ্তক পরিবার কৃতজ্ঞ হয়ে আছি।

২০১২ সাল। আমাদের ক্ষুধা যেন বাড়তেই থাকে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সপ্তক এর পাশাপাশি আরেকটি কাগজ করবো। যেমন কথা তেমন কাজ। ঐ বছরই সপ্তক এর সাথে যুক্ত হলো আশীষ রায়। আমরা হলাম দশ। আমাদের পাশে দাঁড়ালেন মাগুরার দুই খ্যাতিমান শিল্পী হাসয়ারা হাসি আর শিপ্রা দাস। পত্রিকার নামকরণ হলো জলসিঁড়ি। ইছাখাদা ছোটব্রিজ থেকে একটি জলাশয়ে হাসের ছবি আমাদেরকে মুগ্ধ করলে ক্যামেরাবন্দি করা হলো দৃশ্যটি। ঐ দৃশ্য থেকেই মূলত জলসিঁড়ির নামকরণ। এবং ওটাকেই প্রচ্ছদ করা হলো। সহযোগিতা করলো বন্ধু আশীষ রায়। ঐবারই মাগুরা কফি হাউজে হাসি আপা আর শিপ্রাদিকে নিয়ে আড্ডার আয়োজন করা হলো। আড্ডাটাকে সাক্ষাৎকারে রূপ দিয়ে প্রথম সংখ্যাতে প্রকাশ করা হলো। বলে রাখি, আমরা সিদ্ধান্ত নিই সদস্য চাঁদার মাধ্যমেই জলসিঁড়ি প্রকাশ করা হবে। ঐ কর্মটিকে কিন্তু আমরা এখনও বলবৎ রেখেছি। এবং জলসিঁড়ি ক্রমে ক্রমে সপ্তক এর মতই স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠছে। সত্যিই দারুণ ব্যাপার। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পর পর তিন সংখ্যা এক একজন সম্পাদনা করবে। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক শিকদার ওয়ালিউজ্জামান এর সম্পাদনায় পরপর তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। জলসিঁড়ির দ্বিতীয় সংখ্যাটি রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তি উপলক্ষে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত হয়। আশীষ রায়-এর প্রচ্ছদ, রবীন্দ্রনাথের উপর বিকাশ মজুমদারের আর নজরুলের উপ দেলোয়ার হোসেন খান এর গদ্যসমৃদ্ধ হয়ে জলসিঁড়ির দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশ পায়। আগস্টে জলসিঁড়ির ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যাটিতে ঈদের সেকাল একাল প্রবন্ধটি লেখেন মাগুরার প্রবীন শিক্ষাবিদ খান জিয়াউল হক। মুন্সী রইচ উদ্দিনের অনিল দে মণি প্রবন্ধ এবং চণ্ডীদাস-রজকিনীর প্রেমকাহিনী লেখেন গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী। সপ্তক এর তৃতীয় সংখ্যা থেকে সপ্তক সাহিত্য চক্র’র সাথে একাত্ম হয় তরুণ কবি সুদেব চক্রবর্তী। সপ্তক পরিবার দাঁড়ায় এগারোতে। তের নভেম্বরে সড়ক দুর্ঘটনায় মাগুরার উদিয়মান কবি ও প্রবন্ধকার আমাদের বন্ধু রাশেদুল ইসলাম সাজ্জাদকে হারিয়ে ফেললাম। সাজ্জাদের ‘মাগুরা জেলার শিল্পী সাহিত্যিক’ বইটি সপ্তকের ওয়েবসাইটটিকে বেশ সমৃদ্ধ করেছে। মাগুরার সাহিত্যাঙ্গন ও সপ্তক পরিবার সত্যিই সাজ্জাদের কাছে অনেক ঋণী। ডিসেম্বরে সাজ্জাদকে উৎসর্গিত জলসিঁড়ির চতুর্থ সংখ্যাটি আলোর মুখ দেখলো। শতাব্দি জাহিদের প্রচ্ছদে জলসিঁড়ির এ সংখ্যাটি সুনীলের উপর সাগর জামানের প্রবন্ধ, এম মনির উজ জামান আর আলী এহসানের ছোটগল্পে সমৃদ্ধ হলো। এ সংখ্যার মাধ্যমে সপ্তক পরিবারে মিরাজ হোসেন যোগ দিলে সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় বারোতে। এ সংখ্যা থেকে জলসিঁড়ির সম্পাদক মনোনিত হন কবি ও গল্পকার এম মনির উজ জামান। এখন অব্দি তিনিই জলসিঁড়ির সম্পাদক। আমরা জলসিঁড়ির সম্পাদক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি। ১৯ জুলাই ২০১২ সালে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ মৃত্যুবরণ করলে সপ্তক সাহিত্য চক্র একটি শোকসভার আয়োজন করে। মাগুরার আপামর কবি-সাহিত্যিক সে শোকসভায় অংশগ্রহন করেছিল। ২০১২ সালেই মাগুরার প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও ভাষা সৈনিক নরেন্দ্রনাথ স্মৃতি পদক পেলে সপ্তক সাহিত্য চক্র তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করে। এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শিক্ষাবিদ প্রফেসর আব্দুল লতিফ, বাবু চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস, প্রফেসর আব্দুল লতিফ, কবি মিয়া ওয়াহিদ কামাল বাবলু, ডাঃ কাজী তাসুকুজ্জামানসহ জিয়াউল হক স্যারের অনেক ছাত্র প্রাণবন্ত এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করেন। ২০১২ সালেই প্রথমবারের মতো কোন বাইরের জেলায় কবি-সাহিত্যিকদের মেলায় সপ্তক এর প্রতিনিধিত্ব শুরু হয়। সেবার রাজশাহির শাহ মখদুম কলেজ প্রাঙ্গনে কবিকুঞ্জের আয়োজনে জীবনানন্দ কবিতামেলা অনুষ্ঠিত হয়। কবি কামরুল বাহার আরিফের ফোনটি এখনও কানে বাজে। কামরুল বাহার আরিফ আর আরিফুল হক কুমার ভাই আমাদেরকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছেন। তাদের ভালোবাসার কল্যাণেই আমরা খোন্দকার আশরাফ হোসেন, ফখরুল আলম, মোহিত উল আলম, মাকিদ হায়দার, মাকিদ হায়দার, সরোজ দেব, মনজু রহমান, জাকির তালুকদার প্রমুখ অগ্রজ কবি-সাহিত্যিকের সান্যিধ্য পাই। ভালোবাসার সুদৃঢ় এই বন্ধন বিভিন্ন দশকের কবি-সাহিত্যিকের মাঝে সপ্তকের বিস্তৃতির পথকে সুগম করে। ওখানেই অনুজ কবি, অনুবাদক, গল্পকার ও সম্পাদক মোজাফফর হোসেন ও যোবায়ের শাওনে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। সেই থেকে মোজাফফর সপ্তক পরিবারের অংশ হয়ে আছে। ২০১২ সাল সপ্তক সাহিত্য চক্র’র জন্য অনেক স্মৃতির একটি বছর।

২০১৩ সাল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারিদের ফাঁসির দাবিতে দুর্বার শাহবাগ আন্দোলনের বছর। ঐ বছর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম পঞ্চাশের অন্যতম প্রধান কবি শহীদ কাদরীকে নিয়ে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবো সপ্তকের তৃতীয় সংখ্যায়। প্রচ্ছদ করে দিলেন কবি আসাদুজ্জামান খোকন। সপ্তক প্রকাশ পেল। শহীদ কাদরী’র উপর কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, ড. শহীদ ইকবাল, কুমার দীপ, হেনরী স্বপন, মামুন মুস্তাফা, পাবলো শাহী, তুষার প্রসূন, সজল আহমেদ ও নিষাদ নয়ন এর প্রবন্ধ শামস আল মমীনের নেওয়া শহীদ কাদরীর সাক্ষাৎকারটি ক্রোড়পত্রকে সমৃদ্ধ করে।  চিহ্ন সম্পাদক শহীদ ইকবালের নেতৃত্বে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আয়োজনে ‘চিহ্নমেলা’

অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৩ সালে এ মেলার দ্বিতীয় আসরে সপ্তক এর স্টল বরাদ্দ হয় প্রথমবারের মতো। চিহ্নমেলার কল্যাণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ছোটকাগজ আর সম্পাদকদের সাথে পরিচয় হলো, বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। ভালোবাসার বিনিময় হলো ভারতের কবি সুবীর সরকার, দেবযানী বসু, অলোক বিশ্বাসসহ আরো অনেক কবি আর ছোটকাগজ সম্পাদকদের সাথে। চিহ্নমেলার পরবর্তি আসরগুলোতেও সপ্তকের ঋদ্ধ হওয়ার কার্যটি অব্যাহত থেকেছে। এই মেলা থেকেই প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও ইতিহাস গবেষক হোসেনউদ্দিন হোসেন এর সান্যিধ্য পেয়েছি। ২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে সিদ্ধান্ত হলো জলসিঁড়ি প্রকাশ করার। কবি শতাব্দী জাহিদ প্রচ্ছদ করে দিলেন। এ সংখ্যার মাধ্যমে সপ্তক পরিবারে যুক্ত হলো, কবি এস এম কামরুজ্জামান, ছড়াকার রোকেয়া খাতুন ও সেমিকোলন সম্পাদক কবি সোহেল সবুজ। সপ্তক পরিবারের সদস্য হলো পনেরো। সেপ্টেম্বরে প্রয়াত কবি ভোলানাথ সিকদার (১৯৪৯ – ২০০২) এর উপর ক্রোড়পত্রসমেত প্রকাশ পেলো জলসিঁড়ির পঞ্চম সংখ্যা। ভোলাদা’র উপর শিকদার ওয়ালিউজ্জামান, আবু বাসার আখন্দ ও ইব্রাহিম আলী মোনালের প্রবন্ধ, লোকশিল্পী মহেন্দ্রনাথ গোস্বামীর জীবনকথা, তুহিন দাসের অনুগল্প আর সনোজ কুণ্ডু ও এম মনির উজ জামান এর ছোটগল্পে সমৃদ্ধ হলো সংখ্যাটি। এ সংখ্যাতেই যুক্ত হলেন ওপার বাংলার কবিগণ। প্রথমবারের মতো ছড়াপাতাও যুক্ত হলো জলসিঁড়িতে।

সপ্তক কখোনই তার চরিত্র থেকে সরে আসতে চায়নি। লিটলম্যাগের নামে বিগম্যাগ হতে চায়নি সপ্তক। একটি ছোট জেলা শহর মাগুরা থেকে প্রকাশ। ওখানেই আমাদের অহংকার। কখনো ঢাকার ল্যাবেল আঁটতে চায়নি আমাদের সপ্তক-জলসিঁড়ি। কারো নামের সাথে মিলে গেল ওটাও ভাবিনি কোনদিন। আমাদের পরিচয়টাকেই স্বকীয় করতে চেয়েছি সর্বদা। ২০১৪ সাল। আমরা একটি ইউনিক সিদ্ধান্ত নিলাম। অকালপ্রয়াত কবিদেরকে নিয়ে ক্রোড়পত্র করবো। পুরো সংখ্যা করতে চাইলেও আমাদের আর্থিক সিমাবদ্ধতার কথাটি মাথায় রাখতে হয়। তাছাড়া যেভাবেই নিন না কেন, সপ্তক-জলসিঁড়ি কিন্তু সমষ্টিগত প্রয়াস। তাই নিয়মিত বিভাগ রাখতেই হয়। যাহোক, আমরা সুকান্ত ভট্টাচার্য, আবুল হাসান, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, শামীম কবীর ও আপন মাহমুদ অকালপ্রয়াত এই পাঁচ কবি যারা নিজেদের জন্য অনন্য উচ্চতা তৈরি করেছেন, এই পাঁচজনের ক্রোড়পত্র করার সিদ্ধান্ত নিলাম। দুরঙা নান্দনিক প্রচ্ছদ করে দিলেন দ্বিতীয় দশকের কবি ও শল্পী বিধান সাহা। ড. শহীদ ইকবাল, ড. তপন বাগচি, ড. পাবলো শাহী, কবি মাহমুদ কামাল, মোহাম্মদ নূরুল হক, কাব্য মোস্তফা, আঁখি সিদ্দিকা, তুষার প্রসূন ও নিষাদ নয়ন প্রবন্ধ লিখলেন। বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ লিখলেন আলী হাসান ও জহুরুল হক, লোকজ বিষয়ক প্রবন্ধ লিখলেন ড. অনুপম হীরা মণ্ডল। তুহিন দাস, মিজানুর রহমান বেলাল, এম মনির উজ জামান এবং মাজহারুল হক লিপু ছোটগল্প লিখলেন। পশ্চিমবঙ্গের কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধ লিখলেন সুবীর সরকার। ছোট হলেও নান্দনিক একটি সংখ্যা হলো। এখনও এ সংখ্যাটি নিয়েই আমরা আপ্লুত। ২০১৪ সালেই সপ্তকের পক্ষে আমি, সুদেব চক্রবর্তী আর সোহেল সবুজ বগুড়া লেখক চক্র’র কবি সম্মেলনে অংশগ্রহন করি। এ বছরের নভেম্বরেই জলসিঁড়ির ৬ষ্ঠ সংখ্যা প্রকাশের সিদ্ধান্ত হলো। এ সংখ্যাটির জন্য সৈয়দ নাজমুল হাসান লোভনকে অন্যতম উপদেষ্টা সদস্য মনোনিত করা হয়। এ সংখ্যাটিতে ছোটগল্পের উপর জোর দেওয়া হয়। অসিত বিশ্বাস, ইব্রাহিম আলী মোনাল, বীরেন মুখার্জী, মাজহারুল হক লিপু, হোসনে আরা মণি এবং লিটন ঘোষ জয় এর গল্প সমৃদ্ধ করলো সংখ্যাটিকে। এ সংখ্যাতেই প্রথম ভাবনাগুচ্ছ যোগ করা হলো তুষার প্রসূন, গালিব রহমান আর বিধান সাহার। লেবিসন স্কুর আদিবাসি কবিতা, দিলারা রিঙকির অনুবাদ, মাগুরার আঁকিয়েদেরকে নিয়ে আশীষ রায়ের গদ্য, শামীম খানের লেখা সুরতি আলী বয়াতির জীবনী সংখ্যাটিতে ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়।

২০১৫ সাল। অস্থায়ি ভিত্তিতে মাগুরার সব সংগঠনের সমন্বয়ে কবি-সাহিত্যিক ঐক্যজোট গঠন করা হলো। আমাকে আহ্বায়ক আর লিটন ঘোষ জয়কে সদস্য সচিব করা হলো। সিদ্ধান্ত হলো মাগুরার ভাষাসৈনিকদেরকে সংবর্ধনা প্রদানের। সেইসাথে আলোচনা, কবিতাপাঠ ও সঙ্গীতানুষ্ঠান। ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করলেন কবি বিবেকানন্দ মজুমদার। সপ্তক সাহিত্য চক্র’র উপদেষ্টা ও জেলা পরিষদ প্রশাসক এডভোকেট সৈয়দ শরিফুল ইসলাম ও সৈয়দ নাজমুল হাসান লোভন ভাষা সৈনিক খান জিয়াউল হক, আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়া মিয়াকে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন। প্রয়াত ভাষা সৈনিক হামিদুজ্জামান এহিয়া, জলিল খান এবং মির্জা সাখাওয়াত এর স্বজনরা ক্রেস্ট গ্রহন করেন। এ অনুষ্ঠানের নেপথ্যে দারুণ ভূমিকা রেখেছিলেন কবি শামীম খান ও সাইফুল ইসলাম হীরক। প্রয়াত কবি বি এম এ হালিম, কবি সাগর জামান আর আমি বিদ্রোহী কবিতাটি যৌথভাবে আবৃত্তি করেছিলাম যা আজও স্মৃতি হয়ে আছে। লোভন ভাই, আবু বাশার আখন্দ, রওশন আরা লীনা’র মুগ্ধকর আবৃত্তিসহ মাগুরার কবিরা স্বরচিত কবিতা পাঠ করলেন। সন্ধ্যায় হাসিয়ারা হাসি, শিপ্রা দাসসহ মাগুরার সিনিয়র শিল্পীগণ সংগীত পরিবেশন করলেন। কবি-শিল্পীর সামষ্টিক প্রচেষ্টায় দারুণ স্মৃতিময় দিন ছিল সেটা।

২০১৬ সাল। সপ্তক পরিবারের আলোচনায় উঠে এলো, বাঙালীর বৈশাখ এলে জাতীয় দৈনিকগুলো বৈশাখের কবিতা, প্রবন্ধ ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে কিন্তু ছোটকাগজগুলো তেমন কোন কাজ করেনি বৈশাখকে নিয়ে। তাই সপ্তকের পঞ্চম সংখ্যায় বৈশাখের ক্রোড়পত্র করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। প্রচ্ছদ করে দিলেন প্রথম দশকের কবি নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। প্রবন্ধগুলোতে উঠে এসেছে বৈশাখের নানাবিধ বিষয় যা পাঠকের জন্য অনন্য প্রাপ্তি। বৈশাখের উপর প্রবন্ধ লিখলেন হোসেনউদ্দীন হোসেন, সমুদ্র হক, মামুন মুস্তাফা, নুরুজ্জামান মানিক, বীরেন মুখার্জী, তুষার প্রসূন, মনিরুল মনির, রওশন আরা লীনা, শেখর দেব, মোজাফ্ফর হোসেন ও লেবিসন স্কু। বৈশাখের কবিতা আর ছড়াগুলো সত্যিই মুগ্ধকর। ড. রাশিদ আসকারী, ড. তপন বাগচী আর মুসাফির নজরুলের গবেষণাধর্মী প্রবন্ধগুলো ঈর্ষণীয় মাত্রার। ইব্রাহিম আলী মোনাল, এম মনির উজ জামান, সুমন শিকদার, লিটন ঘোষ জয়-এর ছোটগল্প, চরু হক আর তুহিন দাস এর অনুবাদ এবং ড. তপন রায়ের নেওয়া হোসেনউদ্দীন হোসেনের সাক্ষাৎকার সপ্তকের এই সংখ্যাটিকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে।

২০১৭ সাল। এ বছর কোন প্রকাশনা না থাকলেও সপ্তক সাহিত্য চক্র’র প্রাপ্তি হবেনা তা কিন্তু মোটেই বলা যাবে না। আজমুল হক। আমার বন্ধু। ২০১৪ সালে ঝিকরগাছার ইউএনও। ওর নিক নেম কাজল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে তার কবিত্বের সান্যিধ্য পাই। কবি হওয়ার সুবাদে প্রশাসনে থেকে একটি গোছানো বইমেলার আয়োজন করবেনা তাই কি হয়? ঝিকরগাছার হোসেনউদ্দীন হোসেন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎকালে আমার নামটি উঠে আসে। ঝিকরগাছার ওই বইমেলাতেই অনেক বরেণ্য কবি-সাহিত্যিকের আগমন ঘটিয়েছিল কাজল। আমাকেও একদিন বিশেষ অতিথির আসনে বসতে হয়েছিল। ওদিন রাতে হোসেনউদ্দীন হোসেন ভাইয়ের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছিলাম। এ এক দারুণ সুযোগ। ২০১৬ সালে কাজলের ফোন পেলাম। মাগুরার অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক হয়ে আসছে। অনেক পুলকিত হলাম। ২০১৭ সালে মাগুরা বইমেলা আয়োজনের দায়িত্ব আজমুলের কাঁধে পড়লো। অনেক বছর অনুপস্থিতির সৈয়দ আতর আলী গণগ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে আবার বইমেলা হবে ভেবে আমাদের মধ্যে অনেক উচ্ছ্বাস কাজ করলো। বইমেলায় সপ্তক সাহিত্য চক্র’র স্টল যেন কবি-সাহিত্যিকদের প্রাণাধার। সপ্তকের স্টলটিতে সাধারণত সপ্তক এবং মাগুরার কবি-সাহিত্যিকদের প্রকাশনা থাকে। তাই আমাদের তৃপ্তির খোরাক ওখানেই। একটি বই বিক্রি যেন একটি আনন্দের তিলক। ওইবার আজমুল আর আমি আলোচনা করে বইমেলায় হোসেনউদ্দীন হোসেন ভাইকে অতিথি করে আনলাম। হোসেন ভাইয়ের সাহিত্যকর্ম নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার গুরুদািয়ত্বটি আমার উপর পড়লো। অবশ্য কাজলও অনেকটা আলোচনা করলো। সেবারকার বইমেলার তৃপ্তি এখনও খুঁজি আমরা। সন্ধ্যায় কফি হাউজে হোসেন ভাইয়ের সাথে সপ্তক পরিবারের আড্ডাটি অনেক প্রাণবন্ত ছিল। এ আড্ডায় আজমুল ও জেলাপ্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।

২০১৮ সাল সপ্তক সাহিত্য চক্র’র জন্য অনেক চমক ছিল। জলসিঁড়ি প্রকাশ হলো ফেব্রুয়ারিতে। রিঙকু অনিমিখ এর নান্দনিক প্রচ্ছদ ছিল এ সংখ্যাটিতে। এ সংখ্যা থেকেই জলসিঁড়ির লোগো স্থায়িত্ব পায়। এ সংখ্যায় সপ্তক পরিবারে যুক্ত হন সাহান আরা মিশি, নাসরিন আনোয়ার, আসমা আক্তার রুমা, রাইহানা ইসলাম প্রীতি আর তরুণ কুমার বৈদ্য। ফলে সপ্তক পরিবারের সদস্য হয় কুড়ি। এ বছরের মাগুরার বইমেলাটিও সপ্তক পরিবারের জন্য বেশ স্মরণীয়। তৎকালীন জেলাপ্রশাসক মোঃ আতিকুর রহমান কবি, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও সুরকার হওয়ার সুবাদে এ বছরের বইমেলাটি অন্য বছরের তুলনায় ভিন্নতা পায়। অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক আজমুল হকেরও উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল এ বইমেলায়। যাহোক, জলসিঁড়ির এ সংখ্যাটি উৎসর্গ করা হয় কবি করিম চিশতিকে (১৪/১২/১৯৩৮- ১০/০২/২০১৮)। মূলত সংখ্যাটিতে কবিতাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। তারপরও শহীদুল জহিরের ছোটগল্পের উপর মোজাফ্ফর হোসেনের প্রবন্ধ, দেবযানী বসু আর গালিব রহমানের বই আলোচনা আর অকালপ্রয়াত কবি দেবাশীষ মণ্ডলকে নিয়ে রইস মুকুল এর স্মরণগদ্যটি এ সংখ্যার বিশেষ আকর্ষণ।

২০১৮ সাল সপ্তক পরিবারের একটি ভ্রমনবছর। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমরা রাজা সীতারাম রায়ের বাড়ি, মধুমতি নদী, শেখ হাসিনা সেতু আর নদের চাঁদ ঘাট পরিদর্শন করি। আবীর স্মৃতি পাঠাগারের রফিক ভাই আমাদের ছিলেন আমাদের গাইড। তার আতিথেয়তায় আমরা তার কাছে ঋণী। এ বছরের মার্চ মাসে আমরা হোসেন উদ্দিন হোসেন ভাইয়ের আমন্ত্রণে ঝিকরগাছার একটি সাহিত্যসভায় অংশগ্রহন করি। হোসেন ভাইয়ের পারিবারিক আতিথেয়তা সপ্তক পরিবারকে মুগ্ধ করেছিল। দু’ এক মাস পরের কথা। কবিবন্ধু জাকির জাফরান তখন বোয়ালমারি উপজেলার ইউএনও। তার আমন্ত্রনে বোয়ালমারি উপজেলা পরিষদে সপ্তক পরিবার অংশগ্রহন করে। সেবার কবি কাজী ফিরোজ এর বন্ধুতা ও আতিথেয়তা আমাদের জন্য ছিল তৃপ্তির খোরাক।

২০১৯ সাল। নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের প্রচ্ছদে প্রকাশ পেল সপ্তক এর ৬ষ্ঠ সংখ্যা। এটি ছিল অনুবাদ সংখ্যা। অনুবাদ এর উপর ড. রাশিদ আসকারী, ড. শহীদ ইকবাল, কুমার চক্রবর্তী, ইসফানদিয়র আরিয়ন ও নিষাদ নয়নের প্রবন্ধ, মাসুদুজ্জামান, রায়হান রাইন, মাসুদ খান, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, জুয়েল মাজহার, গৌরাঙ্গ মোহান্ত, চরু হক, শাফিনুর শাফিন, নাসিরুল ইসলাম, জাকির জাফরান, শিকদার ওয়ালিউজ্জামান, শফিক সেলিম, শেখর দেব, রেজওয়ান তানিম, রফিকুল কাদির এর অনুবাদ কবিতা, মিলন আশরাফ, মনোজিৎ কুমার দাস, আফসানা বেগম, হাসিনুল ইসলাম, মিয়া রাসিদুজ্জামান, আমিনা শেলী, তুহিন দাস, শুভাশিস সিনহা’র অনবাদকৃত গল্প, পিয়াস মজিদ, মাইবম সাধন, অলাত এহ্সান এর অনুবাদ সংক্রান্ত সাক্ষাৎকার সপ্তককে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে। বরাবরের মত নিয়মিত বিভাগ এ সংখ্যাতেও ছিল। অনুবাদ সংখ্যাটিতে মোজাফ্ফরের সহযোগিতার জন্য তাকে প্রশংসা করে খাটো করতে চাইনে। সে সপ্তক পরিবারেরই অংশ হয়ে গেছে প্রথম থেকেই। কবি নাসিরুল ইসলাম এ সংখ্যায় পৃষ্টপোষকতা দিয়ে সপ্তকের প্রকাশনাকে তরান্বিত করেছে।

২০১৯ সাল সপ্তকের জন্য একটি বিশেষ বছর। এই কারণে বলছি কারণ এ সালটি সপ্তকের সম্মাননার বছর। সম্পাদক হিসেবে আমি কখনোই মাথায় আনিনা যে পুরস্কৃত হতে হবে বা সম্মাননা পেতে হবে। আর এর জন্য সকল প্রকার ম্যাকানিজম করাটাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করি। সপ্তকের পাশে কেউ দাঁড়ালে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ হয়ে যাই। ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দেওয়াতে মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করি। যাহোক কবি ইসলাম রফিক ফোন করে সপ্তকের সব ক’টি সংখ্যা পাঠাতে বললেন। পাঠালাম। কয়েকদিন পর চিঠি পেলাম সপ্তককে সম্মাননার জন্য মনোনিত করা হয়েছে। সাথে একটি সম্মতিপত্র। আমি ফোন করলাম কবি শিবলী মোকতাদির আর ইসলাম রফিকের কাছে। আলাপচারিতায় স্বচ্ছতার শতভাগ নিশ্চিত হয়ে সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করি। আনন্দ পেয়েছি কিন্তু আপ্লুত হইনি। ছোটকাগজ মানেই আন্দোলন। উজানস্রোতে নাও বেয়ে চলা। তাতেই আনন্দ। তাতেই তৃপ্তি। সেই তৃপ্তির কাছে সম্মাননার তৃপ্তি ক্ষীণ। এটা জাস্ট কাজের একটা স্বীকৃতি মাত্র। কবি মাকিদ হায়দার, কবি শোয়েব শাহরিয়ার, কবি আরিফুল হক কুমার, কবি আমিনুল ইসলাম প্রমুখ অগ্রজ কবির হাত থেকে সম্মাননার সকল স্মারক গ্রহনের মুহূর্তটি বেশ রোমাঞ্চকর ছিল।

২০২০ সাল। জলসিঁড়ির ৮ম সংখ্যা প্রকাশের বছর। রিঙকু অনিমিখের করা লাল প্রচ্ছদ কমরেডিও খেতাব পায় বিভিন্ন মহলে। বেশ নান্দনিক প্রচ্ছদ ছিল এটি। তিন দশকের তিন কবির গুচ্ছ কবিতা ছাড়াও অনেক নতুনের কবিতা প্রকাশ পায় এ সংখ্যায়। এ সংখ্যাতে শাহানাজ মৌ, রাফাতুল আরাফাত, সাজিদ বিন আজাদ, আলামিন সোহেল, মিঠুন নন্দী ও দিপালী কীর্তনিয়া সপ্তক পরিবারের অংশ হয়ে যান। সাদ কামালী, নিষাদ নয়ন, বঙ্গ রাখাল, কমল হাসান আর মিঠুন নন্দীর প্রবন্ধ, মুসাফির নজরুল আর দিলারা রিঙকির অনুবাদ, নাহিদা আশরাফী, হোসনে আরা মণি এবং সাহান আরা মিশি আর এম মনির উজ জামান এর ছোটগল্প, এবং বিপুল কুমার রায় আর সুদেব চক্রবর্তীর লোকজ বিষয়ক প্রবন্ধ এ সংখ্যার দারুণ উপস্থাপন।

২০২০ এর মার্চ থেকে করোনা মহামারি শুরু হলেও থেমে থাকেনি সপ্তক পরিবার। ফরিদপুরের বাগাটে সবুজ সরকারের আমন্ত্রণে ছোটকাগজের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান আর মহম্মদপুরের নহাটায় নবমতি সাহিত্য পরিষদের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে সপ্তক পরিবারের অংশগ্রহন স্মরণীয় করে রেখেছে বছরটিকে। এছাড়াও সপ্তক সাহিত্য চক্র’র আয়োজনে ডিসেম্বরে সৈয়দ আতর আলী গণগ্রন্থাগারে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান ও কবিতা পাঠ। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু নাসির বাবলু, কথাসাহিত্যিক হোসনে আরা মণি, মমতাজ বেগম, কবি শামীম খান, নাট্যকার সালাউদ্দিন আহমেদ মিল্টন আর আবৃত্তিকার খান মাজহারুল হক লিপুর আলোচনায় অনুষ্ঠানটি অনেক প্রাণবন্ত ছিল।

২০২০ সাল সপ্তকের দশ বছর পূর্তির বছর। অনেক আগে থেকেই শখ ছিল সপ্তকের একটি ওয়েবসাইট হবে। রাফাতুল আরাফাত এ বছর সপ্তকের জন্য বলা যায় এক অনন্য পাওয়া। বয়স অল্প হলেও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। মিহিন্দা তার অনলাইন ম্যাগ। আমার সাক্ষাৎকারে বেশ খাটিয়েছিল গাজীপুরের ছেলে কিন্তু মাগুরা মেডিকেলে পড়ুয়া এই কবি। মূলত ওর উস্কানিতেই সপ্তক ওয়েবসাইট চালু করার সাহস পাই। ইতোমধ্যেই ক্যাওস নামে অনলাইন ম্যাগটি আমাদেরকে নাড়া দিল। আলাপ হলো অরবিন্দ চক্রবর্তীর সাথে। তার মাধ্যমেই আবিষ্কার করলাম শাব্দিক সাব্বিরকে। বয়স মেপে বুঝা যাবেনা সে কত মেধাবী আর ম্যাচিওর্ড। অত্যন্ত দৃঢ় অথচ চঞ্চল মন আর প্রসন্ন হাসি তার শক্তি। এই বয়সে আবার দারুণ কবিতা লেখে! বয়সটা লুকানোই থাক। ওয়েবসাইট নির্মাণে সপ্তক পরিবার তার কাছে ঋণী। তার উদারতায় সে সপ্তক পরিবারের অংশ হয়ে গেছে। এই ওয়েবসাইটে আমরা কবি সিপাহী রেজার কাছে ঋণী। তিনি ওয়েবসাইটের অনেক ডিজাইন করে দিয়েছেন সময়ের খরচায়।

দশটি বছর মহাকালের কাছে কিছুই নয়। কিন্তু আমাদের সংক্ষিপ্ত জীবনকালের জন্য অনেকটা সময়। এই দীর্ঘ সময়ের স্রোতে কতো স্মৃতি ভেসে গেছে, কত নাম বাদ পড়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। এই তো সেদিনের কথা। দত্তনগর কৃষিফার্মে আমরা বেড়াতে গেলে যে আন্তরিকতা অনুজ কবি শাহাদৎ হোসেন আর যাকির যাপন প্রদর্শন করলো আমরা আজও ভুলিনি। স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৃষি ফার্মের গাছটি। এভাবে অসংখ্য অনুজ আর অগ্রজের কাছে ঋণ তার কত স্মৃতি আড়ালেই চলে গেছে। এই সব মহান ঋণগুলোই সপ্তকের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।

সারকথা

প্রত্যেকটা লিটল ম্যাগই একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীর, নির্দিষ্ট চিন্তার কিছু মানুষের চেতনা নিয়ে গড়ে ওঠে। সেভাবেই তারা আবর্তিত হয়। মাগুরার যে সমস্ত কাগজ হয়েছে এগুলাে কোন সময়ই লিটল ম্যাগ এর আওতায় পড়ে নি। এগুলাে মূলত সাহিত্য পত্রিকা। সপ্তক আর জলসিঁড়িও তেমন সাহিত্য পত্রিকা। কারণ লিটল ম্যাগ হওয়ার পরীক্ষা অনেক। পাস তো করতে হবে!  মাগুরার অগ্রজ কবি-সাহিত্যিকদের সাথে অনুজদের তেমন সম্পর্ক কোনকালেই গড়ে ওঠে নি। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ আলী আহসান, ফররুখ আহমদ, আজিজুল হকের নাম অতি উজ্জ্বল। শেকড়ের সাথে হয়তাে তাদের সংযােগ ছিল কিন্তু মাগুরার লিখিয়েদের সাথে সম্পর্ক ছিল খুবই কম। যােগাযােগ না থাকার কারণে সাহিত্যে সমসাময়িক হালচাল জানার সুযােগ এখানকার লিখিয়েদের খুবই কম হয়েছে। উন্নতমানের লিটল ম্যাগের সাথে পরিচয় তাদের তেমন হয় নি। মাগুরার গণ্ডি থেকে তারা কখনােই বের হতে পারেন নি। এখানে ছােটকাগজ কর্মীদের হয়তাে উদ্দেশ্য ছিল মহৎ কিন্তু লক্ষ্য ছিল সংকীর্ণ। অনেক বছর পরে হলেও সপ্তকের মাধ্যমে মাগুরায় লিটলম্যাগ ধারণা এসেছে। ভবিষ্যতে অনুজপ্রতিমেরা এ ধারা অব্যাহত রাখবে হয়তাে। লিটলম্যাগ ও সাহিত্য পত্রিকার মধ্যে পার্থক্য এখন বুঝতে পারছে পরের জেনারেশন।  সপ্তক লিটল ম্যাগ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে… জলসি়ঁড়িও সপ্তক পরিবারের আর একটি আশ্রয়।

অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমাদের লিটল ম্যাগ চর্চা

কাগজ চর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সবসময় আমাদেরকে ভালােবেসে জড়িয়ে রাখে। সধারণত ছােটকাগজ চর্চায় এগিয়ে আসে তরুণরা। তাদের থাকে উদ্যম কিন্তু পকেট যথেষ্ঠ ভারী না থাকায় দারস্থ হতে হয় বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে। ‘নদীপ্রবাহ”, “সাহিত্য আড্ডা’ ‘জলসিঁড়ি’ ও ‘সপ্তক’ প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা কিছু বিজ্ঞাপন পেয়েছি কিন্তু বেশীরভাগ জায়গা থেকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে। তবে অন্যদিকে বিজ্ঞাপনদাতাদের গড়িমসিতে তরুণরা পড়ে বিপাকে। ছােটকাগজ-এর ক্রেতা সীমিত থাকায় অনেক ছােটকাগজ দু’একটি সংখ্যা প্রকাশের পর বন্ধ হয়ে যায়। এতসব প্রতিবন্ধকতা কিন্তু সপ্তক সাহিত্য চক্রর প্রকাশনাকে বন্ধ করতে পারে নি। সপ্তক সাহিত্য চক্রর তরুণরা কখনও নিজেদের পকেট থেকে অথবা অগ্রজ সাহিত্যিক বা সাহিত্যরসিকদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে ছােট কাগজচর্চা এগিয়ে নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ‘সপ্তকের ৭টি সংখ্যা ও ‘জলসিঁড়ি’র ৮টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। কাগজ দু’টোতে লিখছেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অগণিত তরুণ ও প্রবীণ লেখক। সেখানে গল্প, কবিতা, অনুবাদ, প্রবন্ধ প্রকাশ করতে পেরে দিন দিন কন্ধ মাগুরার সাহিত্য অঙ্গন। আশা করছি অতীতেও যেমন মাগুরার প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিক জাতীয় অঙ্গনে তাদের প্রভাব রেখেছেন আগামীতেও সে ধারা অব্যাহত থাকবে।

সপ্তকের আদর্শ

লিটল ম্যাগাজিন আতুর ঘর থেকেই তারুণ্যের পতাকা বহন করে। নতুন এবং প্রতিশ্রুতিশীল লিখিয়েদের বিকাশের প্রথম আশ্রয়। সৎ সাহিত্যভাবনা ও সমাজ সৃষ্টির দিক-নির্দেশপত্র। লিটলম্যাগ একটি সংগ্রাহাগার, অক্ষরের সমাবেশ আর চেতনার উন্মেষ। লিটলম্যাগ একটি আন্দোলনের নাম। বানিজ্য চিন্তা থেকে বেরিয়ে ব্যতিক্রমী ও সৃজনশীল সপ্তক সাহিত্য চক্র নতুন নতুন প্রচেষ্টা, সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে প্রকাশ করে থাকে সপ্তক ও জলসিঁড়ি। সপ্তক মাগুরায় সুস্থ সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার পথকে এগিয়ে নিতে বন্ধপরিকর। নেতিবাচক গােষ্ঠিবদ্ধতা, মিডিয়াবাজি, তৈলবাজির বিরুদ্ধে সপ্তককর্মীদের কণ্ঠ সর্বদা সােচ্চার। মাগুরার যে কোন প্রান্তে নিভৃতে থাকা যে কোন প্রতিশ্রতিশীল তরুণ সাহিত্যিককে মাগুরার গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাহিত্যচর্চার শ্রোতে মিলিয়ে দিতে চায় সপ্তক। কোনপ্রকার মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সপ্তকের অবস্থান দৃঢ়। আমাদের মূলমন্ত্র আমরা বাঙালি। বাংলাকে মায়ের কোল থেকে জীবনের শেষ অবধি আমরা রক্ষাকবচ করে রাখতে চাই। সপ্তকের লক্ষ্য অটুট..

জলসিঁড়ির আদর্শ

সাহিত্যের প্রতিটি কাগজেরই একটি নির্দিষ্ট আদর্শ ও লক্ষ্য থাকা জরুরি বিষয়। জলসিঁড়িও সপ্তকের মতাে নির্দিষ্ট আদর্শ নিয়ে এগােচ্ছে। জলসিঁড়ি তার জন্ম অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করতে চায়। করছেও। জলসিঁড়ি তরুণ ও নবীন লিখিয়ের লেখা প্রকাশের একটি নির্ভরযােগ্য প্লাটফর্ম। তাদেরকে হাত পাকানাের পাশাপাশি নিজের পাড় ছাপিয়ে অন্য পাড় ছোয়ানাের কাজটিও জলসিঁড়ি করে যাচ্ছে।

শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on whatsapp
Share on email

সর্বশেষ আপডেট